সাংবাদিকরা সমাজের চোখ ও কান, জনসাধারণকে সঠিক ও নিরপেক্ষ তথ্য প্রদানের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে। বাংলাদেশে, যেখানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হুমকির মুখে, সেখানে সাংবাদিকদের সহিংসতা, হয়রানি এবং সেন্সরশিপ থেকে রক্ষা করার জন্য সিদ্ধান্ত মূলক পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা শুধু মানবাধিকারের বিষয় নয়, সুস্থ গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে, বাংলাদেশ আরও উন্মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজের দিকে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারে, যেখানে সাংবাদিকরা সকল নাগরিকদের সুবিধার জন্য নির্ভয়ে কাজ করতে পারে।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হল যেকোন গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি, ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ চেক এবং জনসাধারণের কাছে তথ্য প্রচারের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সাংবাদিকরা এই স্বাধীনতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, প্রায়শই বড় ব্যক্তিগত ঝুঁকিতে। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে সাংবাদিকরা প্রায়ই হুমকি ও সহিংসতার সম্মুখীন হয়, তাদের সুরক্ষার জন্য সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়া কেবল একটি নৈতিক বাধ্যতামূলক নয়; এটা দেশের গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। এই নিবন্ধটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকদের সুরক্ষা এবং তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ মোকাবেলার গুরুত্ব অন্বেষণ করে।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বহু বছর ধরে উদ্বেগের বিষয়। সাংবাদিক প্রায়ই নিজের সরকার, শক্তিশালী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এবং চরমপন্থী শক্তির মধ্যে আটকা পড়েন। বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে দেশটি ১৮০-এর মধ্যে ১৫২ তম স্থানে রয়েছে, যা মিডিয়া দমনের একটি উল্লেখযোগ্য মাত্রা নির্দেশ করে। সাংবাদিক শারীরিক সহিংসতা, ভয়ভীতি, সেন্সরশিপ এবং আইনি হয়রানি সহ অসংখ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রভাব লক্ষণীয় মাত্রায় বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ শুধুমাত্র জড়িত ব্যক্তিদের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে সমাজের জন্য গভীর প্রভাব ফেলে। যখন সাংবাদিকদের উপর হামলা করা হয়, হত্যা করা হয় বা অন্য উপায়ে চুপ করা হয়, তখন এটি একটি শীতল প্রভাব তৈরি করে, অন্যদেরকে সংবেদনশীল বিষয়ে রিপোর্ট করতে নিরুৎসাহিত করে। এটি মত প্রকাশের স্বাধীনতার মৌলিক নীতি এবং জনগণের তথ্য অধিকার ক্ষুন্ন করে। এই ধরনের ঘটনা জনসাধারণকে সরকারি কর্মকাণ্ড, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং জনস্বার্থের অন্যান্য বিষয়ে সমালোচনামূলক অন্তর্দৃষ্টি থেকেও বঞ্চিত করে।
সাংবাদিকদের সুরক্ষায় সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ (আইনি সংস্কার): সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশের যথেষ্ট আইনি সংস্কার করা দরকার। যারা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ করে তাদের জবাবদিহি করতে আইন শক্তিশালী করা জরুরি। দায়মুক্তি দূর করতে হবে, এবং সহিংসতার অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। সাংবাদিকদের মিথ্যা অভিযোগ ও আইনি হয়রানি থেকে রক্ষা করতে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
সহায়তা ব্যবস্থা: সরকারকে হুমকি বা হামলার ক্ষেত্রে সাংবাদিক এবং তাদের পরিবারের জন্য সহায়তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এর মধ্যে আর্থিক সহায়তা, আইনি সহায়তা এবং মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
যখন বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে যখন নানাহ প্রশ্ন, এগুলোর জবাব নিয়ে হাজির হলেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএফইউজে (বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন) এর প্রতিনিধি সম্মেলন-২০২৩-এ বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টকে (বিজেডব্লিউটি) অতিরিক্ত ১০ কোটি টাকা অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রয়োজনের সময় সাংবাদিকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার (বিজেডব্লিউটি) প্রতিষ্ঠা করেছিল। শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের কল্যাণে এবং দেশে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রতি তার অঙ্গীকারের ওপর জোর দেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে তিনি ২০১৪ সালে ৫ কোটি টাকা দিয়ে ট্রাস্ট ফান্ড চালু করার সময়, এটি অন্যান্য ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে সীমিত অবদান পেয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিক সহায়তা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের লক্ষ্যে ‘সাংবাদিক সহায়তা ভাতা ও অনুদান নীতি-২০১২’ এবং ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট আইন-২০১৪’-এর মতো সরকারি নীতি গুলো তুলে ধরেন। বছরের পর বছর ধরে, বিজেডব্লিউটি থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ২০১৫-২০১৬ থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত ৩,৪৩৩ জন সাংবাদিক ও সাংবাদিক পরিবারকে বিতরণ করা ২৯,৮১,৫০,০০০ টাকা তথ্য দেন । মহামারীর, সময় মোট ৬,৭২,৭০,০০০ টাকা দিয়ে ৬,৭২৭ জন উপকারভোগীকে সহায়তার কথা বলেন । মহামারী চলাকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আর্থিক সহায়তার অংশ হিসেবে প্রত্যেক সাংবাদিককে ১০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে বলেও জানান ।
বাংলাদেশে সাংবাদিক, পুলিশ এবং সাধারণ জনগণের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং সচেতনতামূলক প্রচারণা দ্বারা মিডিয়া পেশাদারদের প্রতি সম্মানের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে । এই প্রোগ্রাম গুলোর মধ্যে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ তদন্তের জন্য স্বাধীন সংস্থা গড়ে তুলতে হবে। নিরপেক্ষ ও কার্যকর তদন্ত নিশ্চিত করার জন্য এই সংস্থাগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকদের সুরক্ষা জোরদার করতে বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অংশীদারদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। এটা সর্বোত্তম অনুশীলনগুলি কে ভাগ করে নেওয়া এবং হাই-প্রোফাইল কেস বা বিস্তৃত সমস্যাগুলির সাথে মোকাবিলা করার সময় সহায়তা চাওয়া যেতে পারে।
গ্লোবাল পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনায় দেখা যায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সাংবাদিকদের সুরক্ষা এবং তাদের বিরুদ্ধে অপরাধ মোকাবেলায় সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সমস্ত দেশকে আহ্বান জানিয়েছেন। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য দায়মুক্তির অবসানের আন্তর্জাতিক দিবসের স্মরণে তার বার্তায়, গুতেরেস সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ, তাদের জন্য একটি নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরি, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের বিচারের আওতায় আনা এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সমর্থন করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন।
গুতেরেস সাংবাদিক এবং মিডিয়া পেশাদারদের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন যারা জনসাধারণকে অবহিত রাখতে এবং সত্য রক্ষা করতে তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। তিনি এই ব্যক্তিদের সুরক্ষা বাড়ানোর গুরুত্বের ওপর জোর দেন, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকার করে, ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের জবাবদিহি করতে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অবদান রাখে।
তিনি সত্য উদঘাটন এবং প্রকাশের প্রতিশ্রুতির ফলস্বরূপ সাংবাদিকদের আক্রমণ, বেআইনি আটক, এমনকি মৃত্যু সহ ঝুঁকির কথা তুলে ধরেন। আশ্চর্যজনকভাবে, ২০২২ সালে, ইউনেস্কো রিপোর্ট করেছে যে 88 জন সাংবাদিককে কর্তব্যরত অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
তদুপরি, গুতেরেস উল্লেখ করেছেন যে সাংবাদিকরা যে বিপদের সম্মুখীন হয় তা সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল বাইরেও প্রসারিত হয়, যারা দুর্নীতি, পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এমনকি শান্তিপূর্ণ দেশগুলিতে পরিবেশগত উদ্বেগের মতো বিষয়গুলির বিষয়ে রিপোর্ট কে প্রভাবিত করে। তিনি এই উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হুমকির বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যার মধ্যে রেকর্ড-উচ্চ আটক এবং অনলাইন হয়রানি, বিশেষ করে নারীদের লক্ষ্য করে তাদের কণ্ঠস্বর দমন করার প্রয়াসে।
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ বাংলাদেশে অনন্য নয়। বিশ্বজুড়ে, সাংবাদিকরা তাদের কাজের হুমকি, সহিংসতা এবং দমনের সম্মুখীন হন। তবে সাংবাদিকদের সুরক্ষা শুধু অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়; এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য একটি ভাগ করা দায়িত্ব। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একটি সার্বজনীন অধিকার, এবং সাংবাদিকদের সুরক্ষা বিশ্বব্যাপী বাধ্যতামূলক।
লেখক: একজন মুক্তিযোদ্ধা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি সদস্য, সভাপতি, বাংলাদেশ উত্তর আমেরিকান জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক, ও কানাডার বাসিন্দা।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।